নারীরূপেণ সংস্থিতা – সম্পাদকীয় | শারদীয়া সংখ্যা

পুজোর আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। ফাইলটা বন্ধ করে একগ্লাস জল খেতে খেতে অপর্ণা ভাবে। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার পর থেকে পুজো মানে তার কাছে শুধুই ডিউটি, যথাযথ কর্তব্যপালন। অবশ্য চাকরি বলে নয়, এত বছর বাদেও পুজোতে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হয় অপর্ণার। সেদিন ছিল অষ্টমী। আট বছরের অপর্ণা ছিল তার ঠাকুমার কাছে ভারী অপছন্দের। মেয়েদের দ্বারা বংশ রক্ষা হয় নাকি? তাই অষ্টমীর সকালে অপর্ণার বাবা-মা ওকে ঠাকুমার কাছে রেখে পাড়ার প্যান্ডেলে পুজো দিতে গেলে, ঠাকুমা খেয়ালই করতে পারেন না কখন যেন পাড়াতুতো বিশুকাকু তাকে বারান্দা থেকে চকোলেট দেওয়ার নাম করে নিয়ে যায় তার নিজের খালি বাড়িতে। এরপর অপর্ণার জ্ঞান ফেরে হসপিটালে, সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। ঠাকুমা সেদিনও বলেছিলেন ওই মেয়েই অনামুখো। পুরুষ মানুষ একটু এদিক ওদিক হলে দোষ হয় না। মেয়ের অপমানে, বাবা তাদের নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। বিশুকাকু নিশ্চয় ওখানেই থাকে এখনও। এইসব ভাবলেই ভিতর ভিতর খুব হাঁপিয়ে ওঠে ও। সেই কোন ২২ বছর বয়স থেকে চাকরিতে ঢুকেছে, দেখতে দেখতে আটটা বছর হয়ে গেল। আর এবছর তো ঝঞ্ঝাট আরও বেশী। এই করোনার চক্করে নাওয়া খাওয়ার সময় হচ্ছে না। এদিকে মার বয়স হয়েছে, শরীরটাও বিশেষ ভাল যায়না। ভয় হয় ওর থেকে যেন সংক্রমিত না হতে হয় মাকে। পুজো এলেই বাবাকেও খুব মনে পড়ে, অভিমান হয় খুব। এত তাড়াতাড়ি ওদের একলা ফেলে বাবা চলে গেল! মন খারাপের মাঝেই হঠাতই অপর্ণার মনে পরে পার্বতীর কথা। একটি সংস্থার অ্যাপ ক্যাব চালায়, গত সপ্তাহে থানায় এসেছিল একটা সিগন্যাল ব্রেকের ফাইন ভরতে। কথায় কথায় কিরকম বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওদের। পার্বতীর লড়াইয়ের কথা মনে আসতেই, সাহস পায় অপর্ণা। এখনও অনেকটা পথ চলতে হবে ওকে, অনেক অন্যায়ের জবাব দেওয়া বাকি আছে যে।

এদিকে দীর্ঘ এক সপ্তাহ জ্বরের পর, পার্বতী আজ একটু সুস্থ বোধ করছে। অনেকদিন পর গাড়িটা নিয়ে ও আবার রাস্তায় বেরোবে। এই আনন্দে সক্কাল সক্কাল মেয়েকে টিফিন খাইয়ে, মায়ের ওষুধগুলো বুঝিয়ে দিয়ে, দুটো ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। মহিলা উবের ড্রাইভার হওয়ায় প্রত্যেকদিন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয় পার্বতী। কিন্তু এই কাজ ওর ভারী পছন্দের। প্রত্যেকদিন নতুন করে কত রাস্তা চিনতে পারে, কত নতুন নতুন মানুষের সাথে ওর আলাপ হয় রোজ। অনেকে আবার মহিলা ড্রাইভার বলে উপরি কিছু টাকাও দেয়, যদিও সে টাকা মন থেকে নিতে চায়না পার্বতী। মহিলা বলে কি ও কম কিছু? এই ভাবনা ভেবে কয়েকবার টাকা নিতে অস্বীকার করেছে পার্বতী। অবশ্য সেইদিনগুলোয় রাতে ও আর সুইগির ডেলিভারি করতে বেরোয় না, বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে মেয়েটার সাথে সময় কাটায়। আর উপরি না হলে, বাড়ি ফিরে চা খেয়ে বেড়িয়ে পরে সুইগির ডেলিভারিতে। স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দু-বছরের মেয়েকে নিয়ে মায়ের বাড়িতেই এসে উঠেছিল পার্বতী। বাবা নেই, সংসার বেহাল। তাই স্বল্পশিক্ষিতা হয়েও নিজের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণপণে। মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসা আর মেয়ের পড়াশোনা, দুই-ই চলছে সমানতালে। মাঝে মাঝেই ওর চিন্তা হয় শিবানীর জন্য। গ্রামে শ্বশুরবাড়ির পাশের বাড়ির শিবানী স্বামীর অত্যাচারের হাত থেকে ওকে অনেকবার বাঁচিয়েছে। হয়তো ওর জন্যই পার্বতী আজ নতুন একটা জীবন খুঁজে পেয়েছে। পার্বতী মনে মনে ঠিক করেছে এইবার পুজোর আগেই নতুন একটা কাপড় নিয়ে শিবানীর সাথে দেখা করতে যাবে।

“পুজোর উপহার বিতরণ হচ্ছে ভাই-ভাই ক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে। যারা এখনও সংগ্রহ করেননি, অতি সত্ত্বর ক্লাবে চলে আসুন…” মাইকের ঘোষণা কানে যেতেই কড়াইয়ে তাড়াতাড়ি খুন্তি নাড়ে শিবানী। রান্নাটা নামিয়ে দিয়ে তবে সে ক্লাবে যাবে জিনিস আনতে। গণেশটা স্কুল থেকে ফিরেই বড্ড খাই খাই করে। অবশ্য ওরই বা কি দোষ? সকালবেলা প্রায় কিছু না খেয়েই স্কুলে যায় ছেলেটা। আলু, বরবটী, কলমী শাক দিয়ে ঝোল ঝোল তরকারীটা নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবানী মনে মনে ভাবে ছেলেটার পাতে আজ যদি একটুকরো মাছ দিতে পারত! এই লকডাউনে তার বর এত খেটেও সেরকম রোজগারপাতি করতে পারছে না। এই কিছুদিন আগে অবধিও ক্ষেতের মালিক বলত শঙ্করের হাতে জাদু আছে। কিন্তু এখন নাকি বলেছে চাষের কিসব নতুন আইন হয়েছে, কিজানি তার আর কাজ থাকবে কিনা। ওদিকে আবার পুজো এসে গেল। তবে এবছর বোধহয় ছেলেটাকে কিছুই কিনে দিতে পারবে না পুজোতে। আমফান ঝড়ে বাড়ির উড়ে যাওয়া চালটাই ঠিক হয়নি এখনও। ত্রাণের টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেও লাভ হয়নি বিশেষ। তবে, পুজোর মজা ছিল সেই ছোটবেলায়। শিবানী আর তার প্রিয় বান্ধবী জয়া এ গ্রাম ও গ্রাম চষে বেড়াত। ঠাকুর দেখা, নাগরদোলায় চড়া – সে সব ভারী আনন্দের দিন। তারপর হঠাৎ করেই জয়াটা কোথায় হারিয়ে গেল। একবার পুজোতেই পাশের গ্রামের এক দাদার সাথে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে গেল নতুন জামা পড়ে, আর ফিরল না। বহু খোঁজ খবর করেও কোন লাভ হয়নি। কয়েক বছর পর শিবানীরও বিয়ে হয়ে গেল। ব্যস। তবে ক্লাব এবার খুব সাহায্য করেছে। লকডাউনে খাবার দিয়েছে, আমফানের পরও খাবার, জল, ত্রিপল আরো অনেক কিছু দিয়েছে। দেখা যাক পুজোয় কি উপহার দেয়! “আচ্ছা, জামাকাপড় না দিয়ে সেলাই মেশিন দিতে পারে না”, মনে মনে ভাবল শিবানী? একসময় ভারী সুন্দর ব্লাউজ তৈরি করতে পারত ও।

বিকেল বেলায় ঘরে ধুপ দিতে দিতে জয়া-র হঠাৎ মনে পড়লো সেই পুরোনো পুজোর দিনগুলোর কথা। সেই কোন ছোটবেলায় ওর পাশের পাড়ার দাদা, কলকাতায় পুজোতে ঠাকুর দেখাবার নাম করে এনে ওকে বেঁচে দিয়ে গেল এই মাসির কাছে। তারপরে আরও ১২ টা পুজো ও কাটিয়ে ফেলেছে এই কুঠিবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে খদ্দেরের অপেক্ষাতেই। এবছরও সামনেই পুজো আসছে, মেয়েকে একটা নতুন জামা কিনে দিতে হবে। বারান্দা দিয়ে ধুপ দেখাবার সময় পাশের ঘরে একবার উঁকি মেরে দেখলো লক্ষী পড়ছে। জয়ার বড় সাধ, মেয়েকে লিখিয়ে পড়িয়ে মানুষের মতন মানুষ তৈরি করবে। ধুপকাঠিটা ধুপদানিতে গুঁজে, কাঠের আলমারি থেকে পয়সার কৌটোটা বের করলো জয়া। কিন্তু মেয়ের জামা কেনার মতন টাকাটা বোধহয় এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। আসলে এই মন্দার বাজারে তেমন খদ্দের নেই যে, পেট চালানোই দায় হয়ে পড়েছে, তাতে আবার নতুন জামা..! এই কথা চিন্তা করতে করতেই জয়ার হঠাৎ মনে পড়লো ত্বরিতাদির কথা। ত্বরিতাদি, জয়ার মামাবাড়ির পাশেরবাড়িতেই থাকতো। ছোটবেলায় জয়া মামাবাড়ি গেলে ভারী মজা করে খেলতো দুজনে। অনেকটা সময় তারা একসাথে কাটিয়েছে খেলে ধুলে, গল্প করে। জয়া স্বপ্ন দেখত শিক্ষক হওয়ার আর ত্বরিতাদি বলতো ও ডাক্তার হবে। কিন্তু বিধির বিধান আজ জয়াকে এই জায়গায় এনে ছেড়েছে। জয়া আজ কল্পনা করতে পারে, ত্বরিতা একজন খ্যাতনামা ডাক্তার হয়েছে, অনেক টাকা হয়েছে ওর, হয়তো ওর যা ইচ্ছে করে সেটা ও একবারেই কিনতে পারে। ওর ছেলেমেয়েকে হয়তো এমন শুন্য হাতে পুজো কাটাতে হয়না!

ডঃ ত্বরিতা বিশ্বাস গত ৭ মাসে একদিনও ছুটি পায়নি। দুটো হাসপাতালে ডিউটি তার। এই করোনার আপদকালীন পরিস্থিতিতে ত্বরিতা যে কিভাবে সব সামলে উঠছে তা শুধু ওই জানে। একটানা দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা ডিউটির পর মাঝে বেশ শরীর খারাপ হয়েছিল ত্বরিতার। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত পি.পি.ই পরে কাজ করে ত্বরিতা, করোনা রুগীদের আইসোলেসন ওয়ার্ডে রোগীদের সেবায় ওর কেটে যাচ্ছে মাসের পর মাস। এদিকে সামনে আবার পুজো আসছে, আনন্দের চেয়ে ওর আতঙ্কটাই বেশি। মানুষ যে হারে সংক্রমিত হবে, তা কিভাবে সামাল দেবে, সেই ভয়ে এখন থেকেই খুব চিন্তিত ত্বরিতা। সেই মার্চ মাসের শুরু থেকেই ত্বরিতার ২২ বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি ঘটিয়েছে এই করোনা। হ্যাঁ, ত্বরিতা তার স্বামী কে হারিয়েছে করোনার কবলে পরেই। একই হাসপাতালে কাজ করতো উৎপল, ডঃ উৎপল চৌধুরী। তবে ত্বরিতা কিন্তু এক দিনও হাসপাতাল যাওয়া বন্ধ করেনি। ওর মনের জোর অসীম। সেদিন ফোনে কথা বলার সময়ই ত্বরিতার গলাটা শুনে বুঝতে উমা পেরেছিল যে ওর বন্ধুর শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে মনে মনে। অনেকক্ষন কথোপকথনের পর উমা ত্বরিতা কে মনে সাহস দিয়ে বলেছিল “ডাক্তাররা হল আমাদের সমাজের ঈশ্বর, মানুষের ঈশ্বর। তোমাদের মতন মানুষরা সমাজে আছে বলেই তো এতলোক মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে পারছে”….. উমা যদিও মনে করে ওর জীবনে কিছুই হলো না, সংসার ছাড়া। তবে ত্বরিতা কিন্তু ওকেও দশভূজাই মনে করে, সে কথা ও বলেও উমাকে মাঝে মধ্যেই।

এদিকে আজ সকালে উঠে থেকে হাফ ছাড়ারও সময় পায়নি উমা। এক দুদিন তো নয়, টানা ৭মাস ধরে চলছে এই রোজনামচা। ঘুম চোখে অ্যালার্ম বন্ধ করে, বিছানা ছেড়েই সোজা রান্না ঘরে গিয়ে ঢোকে ও। তারপর ঝড়ের বেগে সকাল পেরিয়ে কিভাবে বেলা হয়ে যায় সেটা টেরও পায়না উমা। বাড়ির যাবতীয় কাজ, বরের ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ছেলের কলেজ আর মেয়ের স্কুল – এর অনলাইন ক্লাস, সবমিলিয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ উমা। সময় মতো জল খাবার দেওয়া, তার উপর এই করোনার এর সময় তো ফলমূল, ভিটামিন ট্যাবলেট সবই সময় মতো খেতে হচ্ছে। গত মাসেই ওদের এক নিকট আত্মীয় চলে গেলেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। “ওগো আমার ওই জিনিসটা দেখেছো ? মা আমার সেই খাতাটা পেয়েছো ? মা এদিকে একটু শুনে যাও প্লিজ ” এসব তো চলতেই থাকে সকাল থেকে রাত। উমা মাঝে মাঝেই একটু বিরতি নিতে চায় এই একঘেয়ে জীবন থেকে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জানলার পাশে বসে আকাশের দিকে ১০ টা মিনিট তাকিয়ে থাকা আর বাথরুমে কাটানো মিনিট ২০ টাই ওর নিজস্ব সময় হয়ে দাঁড়িয়েছে।নিজের সাথে নিজের কথা, মন খারাপ, ক্লান্তি সবকিছুই ওই ৩০ মিনিটে বোঝা পড়া করে নেয় ও। আবার হাসি মুখে care giver এর ভূমিকায় রূপান্তরিত হয়ে যায় Zoology তে MSC , শ্রুতিনন্দনের প্রাক্তন ছাত্রী উমা মুখার্জি। গত কয়েক মাস বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়েই উমা একটা নতুন কাজ শুরু করেছে। এক পরিচিতের মারফত এই কাজের সন্ধান পেয়েছে। আমাদের রাজ্যে যে সব পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে এসেছে, তাদের বেশ কিছু জনের দায়িত্ব নিয়েছে ও। শ্রমিকদের মধ্যে কারো বাসস্থানের সংকট, কারো আবার খাদ্যাভাব, কারো চিকিৎসার প্রয়োজন তো কারো আবার অন্য চিন্তা। এই সব সমস্যার কথা ফোনের মাধ্যমে তারা উমার সাথে ভাগ করে নেয়. এবং উমা তার চেনা পরিচিতদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেগুলো একটি সংস্থার মাধ্যমে সেই শ্রমিক দের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে। এত কাজের মধ্যেও তাদের চিন্তাও সারাক্ষন ঘুরতে থাকে উমার মাথায়। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় যে যদি দশটা হাত থাকতো মা দুগগার মত তাহলে আরো কত কাজ সেরে ফেলা যেত তাড়াতাড়ি।

আমাদের সমাজে এমন অনেক দুর্গা-রা প্রত্যেকদিন তাদের জীবনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। করে যাচ্ছেন প্রাণপণে বেঁচে থাকার লড়াই, বাঁচিয়ে রাখার লড়াই, সংসারে টিকে থাকার লড়াই। তাঁদের এই সংগ্রাম, বহু নারীর আগামীদিনের পথ চলার পাথেয়। সেই সমস্ত দুর্গাদের ‘কথাবৃক্ষ’-এর পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন। আর আপনাদের সবার জন্য রইলো শারদীয়া-র আগাম শুভেচ্ছা। সকলে ভাল থাকবেন, সাথে থাকবেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সুস্থভাবে পুজো কাটাবেন।

প্রচ্ছদ : শুভ্রদীপ

All rights reserved © Kothabriksha 2020

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.