Last updated on October 13, 2020
আজ দুদিন হল নিভু আঁচে পিদিমগুলো শুকোচ্ছে, অনেকটাই শুকিয়েছে কিন্তু পুতুলদুটো এখনো বেশ ভিজে। কাত্তিক মাসে যে এমন বাদল হবে কে জানত?
ফি বছর দুগ্গাপুজো, কালীপুজো এছাড়া অন্য পালাপার্বণেও জমিদার বাড়ির পিদিমের বরাত সে পায়। গ্রামের অন্য বাড়ি থেকেও লোকজন আসে নিতে। কত রকমের বাহারি মোম, আলো এখন বাজারে তাও জমিদার বাড়ি, এই গাঁ ও আশপাশের কয়েকটা গাঁয়ের লোকের কাছে তার বানানো পিদিমের খুব কদর। চাষের জমিও আছে কিছুটা কিন্তু চাষবাসে তার মন নেই। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মা সব তদারকি করত, এখন বয়েসের জন্যে মাও আর পেরে ওঠে না। তাই পরাণ সেই সব জমি ভাগচাষে দিয়ে দিয়েছে। তার মাটির জিনিস বানানো আর চাষ থেকে যা আসে তাতেই তাদের মা ছেলের চলে যায়।
তার আরো একটা নেশা হল বাঁশি। নিজে হাতে বানানো আর তারপর তাতে সুর তোলা, এতে যে কি সুখ তা বোঝানো যায়না।
পিদিম বিক্কিরি ছাড়া জমিদার বাড়ি যাওয়ার আরো একটা টান হল বিধুমুখী, জমিদার মশাইয়ের মেজোমেয়ে। একতলার পূবের দিকের শেষ ঘরটিতে সে থাকে। তাকে সেখানে বন্ধ করে রাখা হয়। মাথার ব্যামো আছে নাকি তার, কি যে বলে আপনমনে কিছুই বোঝা যায় না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে ধরেধরে ঠাকুর দালানে নিয়ে আসেন গিন্নীমা।
এইরকমই বেশ কয়েক বছর আগে দুগ্গোপুজোয়, সন্ধি পুজোর সময় বিধুমুখী গিন্নীমার হাত ধরে এসে দাঁড়াল ঠাকুর দালানে।
আপন মনে গেয়ে উঠল “এবার আমার উমা এলে, আর উমায় পাঠাব না..” পরাণও নিজের অজান্তে কখন কোঁচড় থেকে বাঁশি বের করে সুর ধরল। ভাবের ঘোরেই ঘটে গেল সবটা। বাজনা শেষ হলে ঘোর কাটলে মনে হতে লাগল এ কি কান্ড করল সে! জমিদারবাবু নিশ্চয়ই ভয়ংকর রেগে গেছেন। কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “এবার থেকে প্রত্যেক বছর সন্ধিপুজোর আরতি শেষে বিধুমা গাইবে আর পরাণ বাজাবে।” ফি বছর সেটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়াল।
বাড়ি ফিরে সে বছর প্রথম একটা পুতুল গড়ল পরাণ। শ্যামা পুজোর পিদিম দিতে যাওয়ার সময় পুতুলটাও সঙ্গে নিয়ে গেল সে। ভয়ে ভয়ে গিন্নীমা কে সেটা দিয়ে বলল “বিধুমুখীর জন্য এনেছিলাম।” গিন্নীমা বললেন “যা নিজে গিয়ে দে ওকে, জানলাতেই তো বসে থাকে সারাদিন, দিয়ে আয়।” জানলার সামনে গিয়ে দেখল, বিধু তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। পরাণ পুতুলটা এগিয়ে দিল জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে, তাকিয়েও দেখল না বিধু। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পথ ধরল পরাণ। কিছু দূর এগিয়ে পিছন ফিরে দেখে পুতুলটা হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে বিধু। মনে মনে একটা তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরল পরাণ। এরপর থেকে যখনই পিদিম নিয়ে যেত সে, সঙ্গে বিধুমুখীর জন্য নিয়ে যেত মাটির পুতুল। ক্রমশ একটু একটু করে সহজ হচ্ছিল ওরা। পুতুলগুলো হাত বাড়িয়ে নিত আজকাল বিধু। পরাণও ছটফট করত বিধুকে একটু চোখের দেখা দেখবার জন্য। কিছুই বলত না কখনো কিন্তু কখনো সখনো আপন মনে গান গাইত বিধু আর চুপটি করে শুনত পরাণ।
কিন্তু এবছরটা সত্যি খুব চিন্তায় আছে পরাণ। এত পিদিমের বরাত, তার সঙ্গে এবছর দুটো পুতুল বানিয়েছে সে। এমন বাদল, ঠিক করে শুকোচ্ছেই না। আগুনের তাপে কিছুটা শুকোনোর চেষ্টা করছে, কি হবে কে জানে!
অবশেষে আকাশ কিছুটা পরিস্কার হওয়াতে দিনেরবেলা রোদে আর রাতেরবেলা উনুনের নিভু আঁচ, মালসায় করে কাঠকয়লার আগুন, এইসব করে শুকোলো পিদিমগুলো আর পুতুল দুটো। পঞ্চমীতে সেগুলো নিয়ে হাজির হল পরাণ জমিদার বাড়ি।পিদিমগুলো ঠাকুরদালানে নামিয়ে রেখে, পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বিধুর জানলার সামনে।কিন্তু কই বিধু তো নেই সেখানে! কি করে এবার সে? দুএকবার বিধুর নাম ধরে ডাকল কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। পুতুলগুলো দেবে না? একরাশ মনখারাপ নিয়ে পেছন ফিরেছে বাড়ির পথ ধরবে বলে, খসখস আওয়াজ। ঘুরে দেখে বিধু এসে দাঁড়িয়েছে জানলার সামনে। ছুটে গেল পরাণ। কি অদ্ভুত, পরাণ কে দেখেই হাত বাড়িয়ে দিল বিধু, এই প্রথম।পুতুল দুটো বাড়িয়ে দিল পরাণ বিধুর দিকে। বিধুর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল পরাণ, বিধু তখন এক মনে পুতুল দুটো দেখছে। কি যে দেখছে কে জানে! তারপর পরাণও বাড়ির পথ ধরল। কিন্তু বাড়ি ফিরেও বিধুর চোখ দুটো বারবার ভেসে উঠছিল তার চোখের সামনে, কি যে এক সারল্য ওই চোখদুটোয়, কেন যে একটা কষ্ট দলা পাকাচ্ছিল বুকের ভেতর, কিছুই বুঝতে পারছিল না পরাণ।
পুজোর চারটে দিন ওদের মা ছেলের জমিদার বাড়িতে দুপুরে নিমন্ত্রণ থাকে। আজকাল আর মা রোজ যেতে চায় না, একটা দিন যায়, সন্ধিপুজোর দিনটা। তবে ও রোজ যায়। এবারও তার অন্যথা হল না। সন্ধি পুজো শুরু হবে। পিদিমের আলোয় ঠাকুরদালান জ্বলজ্বল করছে। বাসন্তীরঙা শাড়ি পরে বিধু ওর মায়ের হাত ধরে এসে দাঁড়াল ঠাকুরদালানে। যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। পরাণ চোখ ফেরাতে পারছিল না। পুজো শেষ হল, গান ধরল বিধু আর বাঁশিতে সুর তুলল পরাণ “তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে…” সুরে সুরে ভেসে যাচ্ছিল চারিপাশ। সেই ঘোর নিয়েই বাড়ি ফিরে এলো পরাণ।
এই প্রথম ভাসানের সময় জমিদার বাড়ি গেলনা পরাণ।কাল থেকেই মনটা তার ভালো নেই। কেন সে নিজেও জানেনা। মায়ের কথা শুনল না সে গেল না সেখানে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে।বাইরে রাস্তা দিয়ে বেশ কিছু মানুষের উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পেল পরাণ। যতটুকু বুঝল, জমিদার বাড়িতে কিছু একটা সর্বনাশ হয়েছে। মনটা কু গেয়ে উঠল। ছুট লাগাল জমিদার বাড়ি। ঠাকুরদালান শুনশান। শুধু একটা প্রদীপ জ্বলছে। সারা বাড়ি জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। এমন সময় শিউরাম এসে দাঁড়াল তার পাশটিতে। “বিটিয়া নেই গো,” বলে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল সে। কিছুই বুঝল না পরাণ, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর যতটুকু বুঝল, কোনো কারণে কেউ বিধুর ঘরের দরজা তালা দিতে ভুলে গেছিল, সবার তখন বিসর্জনের তাড়া। বিধু সোজা বেরিয়ে পুকুরে।
কোনোমতে মনটাকে টেনে নিয়ে এসে দাঁড়াল বিধুর জানলার সামনে। গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল তার বানানো একটা পুতুল পড়ে আছে সেখানে। দুমড়ে মুচড়ে উঠল বুকের ভেতরটা। নিজের অজান্তেই চলে এলো পুকুর ঘাটে। রাঙচিতের ঝোপের ধারে দু টুকরো হয়ে পড়ে আছে অন্য পুতুলটা। সামনে থৈথৈ জলরাশি আর অপার শূন্যতা।
বিধু গাইছে বাঁশিতে সুর তুলছে পরাণ, “আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়, পাড়ে লয়ে যাও আমায়।”

প্রচ্ছদ: অনির্বাণ পাল
লেখক পরিচিতি: ঐন্দ্রিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার পাঠভবন স্কুলের ছাত্রী, তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। গানের শিক্ষিকা। অবসরের ভালোলাগা হল সাহিত্যচর্চা।
Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.
Be First to Comment