বেশ কয়েকমাস হলো আমাদের শহর মুখ ঢেকেছে।
অলিতে গলিতে কাজ করছে নিস্তব্ধতা। কিন্তু কিসের সেই নিস্তব্ধতা? যান্ত্রিক নিস্তব্ধতা। কান পাতলেও – বাস, ট্রাম, গাড়ি, মানুষের কোলাহল এইসব কিচ্ছু শোনা যাচ্ছিল না। তবে শোনা যাচ্ছিল পাখিদের ডাক, অনুভব করা যাচ্ছিল যে প্রকৃতি প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে।
জানালা দিয়ে এক টুকরো শহরটাকে দিব্যি লাগছিল। তবে ওই জানালা দিয়ে দেখা শহরটা বেশিরভাগ মানুষের মনেই একটা বিষাদ তৈরী করেছে। মনের প্রেক্ষাপটে যে কল্লোলিনী বিরাজমান, মন বার বার তাকেই চায় আরো বেশি করে, ঠিক আগের মতো। কিন্তু চাইলেই কি আর পাওয়া যায়..?
শহরের প্রাণ ফেরাতে দরকার বাসের হর্ণ, ট্রেনের কু ঝিক ঝিক, দোকানে বাজারে মানুষের আওয়াজ, গাড়ির ধোঁয়া, রাস্তার ধারে ফুচকার দোকানে গোল করে ফুচকা খাওয়ার ভিড়, রোল, তেলেভাজা, বন্ধুদের সাথে হইহুল্লোড়, গানের আসর, নাটক দেখা, বই কেনা – এই সব কিছু মিলিয়েই তো আমাদের শহর, তার স্বাভাবিকতা এটাই।

তবে চারিপাশের গন্ডির বাঁধনটা ধীরে ধীরে বেশ আলগা হয়েছে। সরকারি আদেশানুসারে চালু হয়েছে বহু অফিস। আসলে চালু না করেও যে উপায় নেই.! পেটের খিদে, মানুষের চির শত্রু। সেই শত্রুর শত্রুতা মেটাতেই আজ আবার নতুন করে রাস্তায় নামা। কিন্তু এই ‘নতুন’ টা কি খুব স্বাভাবিক ছন্দে নতুনত্ব পেয়েছে..? দীর্ঘ আড়াই মাস অন্ধকারে কাটানোর পরে, কল্লোলিনী আবার আশার আলো দেখেছে। না এই অন্ধকারে রাস্তায় আলো জ্বলেছে, আলো জ্বলেনি বাড়িগুলোতে, আলো জ্বলেনি মানুষের অন্তরে। একদিকে চির শত্রুর শত্রুতা আরেকদিকে মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। সেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই আজ রোগকে বরণ করেও আমাদের পথে নামা। তবে এই মুক্তির কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা কাজ করছে। এদিকে ঘোষিত ভাবে লকডাউন বহাল রয়েছে শহরে, অথচ কাজে বেরোতে হচ্ছে সকলকেই।
এখনো স্বাভাবিক হয়নি মেট্রো ও রেল চলাচল, স্বাভাবিক হয়নি বাস ব্যবস্থাও। না এই তিনটি যানবাহনের কথা উল্লেখযোগ্য কারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালির চলাফেরার মূল মাধ্যম কিন্তু ওলা বা উবের নয়। যে পরিমান মানুষের ভার আমাদের শহর বহন করে তাতে এই তিনটিই যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে সরকারি বাস রাস্তায় চললেও, এই বিপুল জনসংখ্যা সামাল দেওয়া একপ্রকার অসম্ভব। আবার ওদিকে সীমিত প্যাসেঞ্জার নিয়ে রাস্তায় বেসরকারি বাস নামাতে গেলে যে পরিমান ভাড়া দরকার, সেই ভাড়া সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী বাঙালির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় এবং ভাড়া না বাড়িয়ে রাস্তায় বাস নামাতে হলে বাস মালিকদের ব্যবসা লাটে উঠবে।

আর চাইলেও ট্রেন এবং মেট্রো চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব নয় কারণ এই মাধ্যমে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে, তাতে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা অনেকগুন বেড়ে যায়।
এবার আসি ওলা-উবের এর কথায়। ২০১৩ সালে খুব রমরমা ভাবে ওলা-উবের সার্ভিস শুরু হলেও ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে থেকেই এদের সার্ভিস কোয়ালিটি লো হতে শুরু করে। দূরের রুটে গাড়ির যেতে না চাওয়া, পিক-আওয়ার এ অতিরিক্ত ভাড়ার দাবি, বৃষ্টিতে গাড়ি না পাওয়া, কলকাতা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তেমন একটা ভালো সার্ভিস না দেওয়া – এই সমস্ত নেগলিজেন্সির কারণে দিনে দিনে এদের সার্ভিস খারাপ হতে শুরু করে। এরপর খাড়ার ঘা হয়ে কোপ ফেললো করোনা এবং লকডাউন। পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম হুহু করে বেড়ে যাওয়ায় হলো আরো সমস্যা। আজকাল যেটা রাস্তায় দেখা যাচ্ছে তাতে গাড়ি চালকেরা অধিকাংশ ট্রিপ ক্যান্সেল করে দিচ্ছে, কারণ তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ভাড়ার ৩০% কমিশন কোম্পানি কেটে নিচ্ছে এবং তার ফলে যা টাকা ড্রাইভারদের হাতে আসছে তাতে তেল খরচই উঠছে না। কাজেই বন্ধ হয়েছে গাড়িতে এসি চালানো এবং দুজনের বেশি প্যাসেঞ্জারের ওঠাও নিষিদ্ধ হয়েছে। ড্রাইভার এবং প্যাসেঞ্জারের সিটের মাঝখানে মোটা প্লাস্টিকের গার্ড লাগিয়েই চলছে ওলা-উবের।

১০ টাকার রিকশা ভাড়া বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে, কিন্তু প্যাসেঞ্জার নেই রাস্তায়। করুন চোখ করে চাতক পাখির মতন একটি প্যাসেঞ্জারের আশায় কয়েকঘন্টা রোদে বসেই কাটিয়ে দিচ্ছেন তারা। অটোও চলছে পিছনে দুজন এবং সামনে একজন নিয়ে। সেখানেও রয়েছে ড্রাইভার এবং প্যাসেঞ্জার সিটের মাঝখানে গার্ড। ভাড়াও বেড়েছে কিছুটা, চারজনের ভাড়া ভাগ হচ্ছে তিনজনের মধ্যে।
বেসরকারি স্কুলগুলোতে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যেতে হচ্ছে স্কুলে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ছাত্রদের একত্রিত করে ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু পড়াশোনার মতন জটিল একটা ব্যাপার এই ধরণের মিডিয়া দ্বারা কি আদেও সম্ভব..? কিন্তু না করেও যে উপায় নেই, শিক্ষকদের মাইনে দিতে গেলে দরকার বিপুল পরিমাণ অর্থবল এবং সেই অর্থবলের প্রধান কান্ডারি হলো ছাত্র-ছাত্রীরা। কিন্তু স্কুলের অ্যাক্টিভিটি পুরোপুরি বন্ধ থাকলে মাসের পর মাস মাইনে দিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয় অভিভাবকদের পক্ষে। কাজেই অগত্যা উপায় অনলাইন ক্লাস, যা চলছে রমরমিয়ে।
অফিস-কাছারি বেশ খানিকটা স্বাভাবিক হলেও, বাজার এলাকাগুলো ধুঁকছে। হাতিবাগান, গড়িয়াহাট, ধর্মতলার মতন গমগমে বাজার এলাকায় আজ তালা পরে সন্ধ্যে ৬ টার মধ্যে। যে শহর ঘুম ভেঙে প্রাণ ঢালতো বিকেল বেলায়, সে শহর আজ বিকেল হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়ে। খোদ্দেরের অভাবে সময়ের অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যায় দোকান পাট। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে শখ-শৌখিনতা বজায় রাখা শুধুমাত্রই বিলাসিতা, সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে। কিন্তু এই বিলাসিতাই যে বহু মানুষের প্রয়োজনের চাবিকাঠি তা আজ সত্যিই ভাবলে অবাক লাগে।
শহরের প্রসেনিয়াম থিয়েটারগুলো বন্ধ, বন্ধ সিনেমা হল। এমুহূর্তে শুধুমাত্র বিনোদন বিলাসিতা বলে যে এই জায়গাগুলো বন্ধ, তা নয়। কোথাও একটা জনসমাগমের ভয়েও এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে জায়গাগুলোকে। বিনোদন জগতের মানুষদের জীবনেও নেমে এসেছে এক গভীর অনিশ্চয়তা।
একটা ভাইরাস এসে সবটাই কেমন যেন উলোট পালোট করে দিল। বদলে গেল আমাদের দিন যাপন, চাওয়া পাওয়া। বদলে গেল হাজার হাজার মানুষের জীবিকা। বদলে গেল দিন, বদলে গেল সময়। কিন্তু শহর টা..? আমাদের প্রানের কলকাতা..? সেও কি তাহলে বদলে গেল..?
জানিনা, তেমন তো মনে হয়না। প্রানের শহরে প্রাণ থাকবে না, এটা হয় নাকি..? শহর একই আছে, শুধু গতি রুদ্ধ রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রাণ ঢালার পরে, কল্লোলিনী আজ একটু বিশ্রাম নিচ্ছে আগামীর প্রাণ ঢালার প্রেরণায়। জনজীবন শুধু একটু থমকে দাঁড়িয়েছে কিন্তু থমকানো মানেই যে থেমে যাওয়া নয়, সেটা ভেবেই তো আবার পথে নামা। একটা বিশ্রামের পর আবার নতুন উদ্যমে চলার জন্য ধীরে ধীরে তৈরী হওয়া। স্বভাবিকতার অপেক্ষায় থাকবো আমরা সকলেই।

প্রচ্ছদ : © Pritam Chowdhury
© Kothabriksha 2020, All Rights Reserved. Ze
পাঠ করে তৃপ্তি পেলাম। অকারণে মাইক বাজিয়ে শব্দ দূষণ কিছুটা হলেও কমেছে